বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দীর্ঘ যাত্রাপথে খালেদা জিয়া সেই অনিবার্য ও অপরিহার্য নেত্রী, যাঁকে উপেক্ষা করে ইতিহাস লেখা অসম্ভব। দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, কারাবাস, পারিবারিক শোক—কোনো কিছুই তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বরং প্রতিটি প্রতিকূলতার মধ্যেই তিনি প্রমাণ করেছেন নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব, দৃঢ়তা এবং সংকটকালে অটল থাকার সাহস।
স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে তাঁর অবদান ছিল বিরল কৌশল, ধৈর্য এবং অনমনীয় সাহসের সমন্বয়। ওয়ান-ইলেভেনের ‘মাইনাস টু’ পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়া থেকে শুরু করে একদলীয় নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করা—প্রতিটি অধ্যায়ে খালেদা জিয়া ছিলেন গণতন্ত্রের প্রধান শক্তি। রাষ্ট্রীয় শক্তির নির্মমতা, রাজনৈতিক মামলা, কারাবাস, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ কিংবা পরিবারকে টার্গেট করা—কিছুই তাঁকে দুর্বল করতে পারেনি। এই দৃঢ়তা তাঁকে দিয়েছে ‘বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব’ মর্যাদা।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যা-পরবর্তী গভীর রাজনৈতিক সংকটের সময়ে দলের নেতাদের আহ্বানে তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮২ সালে সদস্যপদ নেওয়ার মাত্র তিন মাস পর দেশ পতিত হয় সামরিক শাসনে। জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সামনে আসেন। ১৯৮৩ সালে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং ১৯৮৪ সালে চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়ে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব আরও শক্তভাবে ধারণ করেন।
১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে তাঁর নেতৃত্ব স্বৈরাচার পতনের পথ প্রশস্ত করে। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে এবং তিনি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর আমলে একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনসহ গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পরিবর্তন আনা হয়।
১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে বড় ব্যবধানে বিজয়ী হওয়া খালেদা জিয়াকে বিশ্বরাজনীতিতেও আলাদা মর্যাদা এনে দেয়। তাঁর নেতৃত্বে অর্থনীতিতে মুক্তবাজার নীতি, করহার কমানো, শুল্ককাঠামো সহজকরণ, নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার, শিল্পায়ন ও নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। শিক্ষা, নারী ক্ষমতায়ন, বিচার বিভাগ স্বাধীনকরণ, দুর্নীতি দমন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, পরিবেশ সুরক্ষা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত সরকারের আমলে তাঁকে পরিবারসহ টার্গেট করা হয়, গ্রেপ্তার করা হয় দুই ছেলেকে, পরে তাঁকেও কারাগারে নেওয়া হয়। তবুও কারাবাসে থেকেও তিনি দলের নেতৃত্ব ধরে রাখেন এবং সব ধরনের সমঝোতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ২০০৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের পরও তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন চালিয়ে যান।
২০১৮ সালের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় তাঁর কারাদণ্ড এবং পরবর্তী চিকিৎসা-সংকট গণতন্ত্রপন্থী মহলে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি করে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই রাষ্ট্রপতির আদেশে তাঁর মুক্তি ঘোষণা করা হয়। মুক্তির পর তিনি দলকে পুনর্গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামে খালেদা জিয়া আজও গণমানুষের আশার প্রতীক। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অদম্য নেত্রী—যাঁর দৃঢ়তা, ত্যাগ, নীতি ও নেতৃত্ব দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আলোকিত গৌড়/আ
মন্তব্য করুন: