ভারতশাসিত কাশ্মীরের শ্রীনগরের একটি সরু গলিতে প্রতিদিনই ভেসে আসে দুই শিশুর কান্নার শব্দ—তাদের মা সাত মাস আগে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জোর করে ধরে নিয়ে গেছে।
তিন বছরের হুসেন কাঁদতে কাঁদতে পথচারীদের অনুরোধ করে, “আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যান।” তার ছোট বোন নূরীও জানালার লোহার গরাদ ধরে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি নাগরিক সামিনা ছিলেন এই দুই শিশুর মা। ২০১৮ সালে কাশ্মীরি মজিদের সঙ্গে বিয়ে করে সেখানে স্থায়ী হন তিনি। কিন্তু এ বছরের ২৮ এপ্রিল হঠাৎ করে তাকে থানায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে পাকিস্তানে নির্বাসিত করা হয়। সেই রাত থেকে শুরু হয় এই পরিবারের অমানিশা।
পেহেলগাম এলাকায় হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত অভিযোগ তোলে যে নিহতদের মধ্যে পাকিস্তানিও ছিল। এরপর পেহেলগাম হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত দ্রুত পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক কমিয়ে দেয়, বাণিজ্য স্থগিত করে এবং পাকিস্তানিদের সব ভিসা বাতিল করে দেয়। ২৯ এপ্রিলের মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় ওয়াঘা সীমান্তও। ফলে প্রায় ৮০০ পাকিস্তানি নাগরিক, যাদের অনেকে ভারতীয় স্বামী-স্ত্রীসহ পরিবার গড়ে তুলেছিলেন, তাদের নির্বাসিত করা হয়। সীমান্তের দু’পাশে শুরু হয় বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলোর দীর্ঘ অপেক্ষা ও কান্না।
দিল্লির মুহাম্মদ শাহবাজের স্ত্রী এরুমও এই তালিকার অংশ। পাঁচ বছর ভিসা না পেয়ে পাকিস্তানে আটকে থাকা এরুম এ বছর ১৭ এপ্রিল ভারতে ফিরেছিলেন। পাঁচ বছরের অপেক্ষার পর তাদের সংসার আলো ফিরে পেয়েছিল। কিন্তু পেহেলগাম হামলার ১২ দিন পরই তাকে আবার পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়। শাহবাজ বলেন, “চোখের পলকে সব ভেঙে গেল।”
কাশ্মীরের ৬৫ বছর বয়সী পারভীনা ১৯৮২ সালে স্বামী রেহমানকে বিয়ে করেন এবং এরপর আর কখনো পাকিস্তানে ফেরেননি। সন্তান-স্বামীসহ বারামুল্লায় দীর্ঘ সংসার গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু তাকেও এপ্রিলে নির্বাসিত করা হয়। ৪০ বছরের সংসার এক সিদ্ধান্তে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। রেহমান বলেন, “আমি জানি না আর তাকে দেখতে পাব কি না।”
কুপওয়ারার ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল্লাহর স্ত্রী তামারাহকেও নির্বাসিত করা হয়। ১৮ মাস বয়সী জমজ সন্তানদের বুকের দুধ খাওয়ানো চলছিল তখনও। তাকে সীমান্তে পাঠানোর সময় আবদুল্লাহ দুই শিশুকে নিয়ে পুলিশের গাড়ির পেছনে ৫০০ কিলোমিটার পথ দৌড়েছিলেন, কিন্তু তাদের শেষ দেখা দেখারও সুযোগ দেওয়া হয়নি। তিনি ভেঙে পড়ে বলেন, “কেন আমাদের নিরীহ শিশুদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে? তাদের কী দোষ?”
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, পাকিস্তানি নাগরিকদের নির্বাসনের সঙ্গে পেহেলগাম হামলার কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কলিন গনসালভেস মন্তব্য করেন এটি “বিপজ্জনক ও ভিত্তিহীন অজুহাত।” সরকারের নিরাপত্তাজনিত যুক্তি প্রশ্নবিদ্ধ হলেও শত শত পরিবার আজ বিচ্ছিন্ন, অনিশ্চয়তা আর মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছে।
সূত্র: আল জাজিরা
আলোকিত গৌড়/আ
মন্তব্য করুন: