জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ পুরো দেশ। সময়ের সাহসী এই রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনকর্মীর অকালপ্রয়াণে শোক আর ক্ষোভে ফেটে পড়েছে লাখো মানুষ। মৃত্যুর পর যেন আরও শক্তিশালী হয়ে তিনি ফিরে এসেছেন তরুণদের হৃদয়ে—এমন অনুভূতি জানাচ্ছেন জানাজায় অংশ নেওয়া মুসল্লিরা।
শনিবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুর ২টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ওসমান হাদির জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এরপর তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে সমাহিত করা হবে। তবে সকাল থেকেই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে মানুষের ঢল নামে। রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পায়ে হেঁটে হাজারো মানুষ সেখানে জড়ো হতে থাকেন। বেলা দেড়টার আগেই মানিক মিয়া সড়ক জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
জানাজায় অংশ নেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোহাম্মদ মিলন মিয়া বলেন, “জানাজার নামাজে এত মানুষ কবে দেখেছি মনে নেই। দ্রুত হাদির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।” তার মতো অনেকেই অভিযোগ করেন, একটি মহল খুনিদের ধরতে গড়িমসি করছে।
জানাজায় অংশ নিয়েছেন লাখো বিক্ষুব্ধ মানুষ। জুলাই যোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিও তুলেছেন তারা। শরীরে লাল পতাকা জড়িয়ে জানাজায় অংশ নেন সাভার কলেজের শিক্ষার্থী আরিফিন শাওন। হাদিকে কখনো সরাসরি না দেখলেও কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। শাওন বলেন, “ওসমান হাদি ভাইয়ের হত্যার বিচার না হলে আমরা কেউ নিরাপদ নই।”
মিরপুরের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ তারিফ বলেন, “হাদিকে কখনো দেখিনি, কিন্তু মনে হয় তিনি আমার আপন ভাই। জীবনে এমন জানাজা আর দেখিনি।”
বিশেষ করে মিরপুর, গাবতলি, মোহাম্মদপুর, বছিলা, উত্তরাসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ পায়ে হেঁটে জানাজায় অংশ নেয়। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘আমরা সবাই হাদি হবো, যুগে যুগে লড়ে যাবো’—এমন স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
টানা সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে না ফেরার দেশে চলে যান শহীদ ওসমান হাদি। তার মৃত্যুতে শনিবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষে দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।
জানাজায় অংশ নিতে এসে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি অনেক প্রবীণও। প্রায় ৮০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অঝোরে কাঁদতে দেখা যায়। স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে প্রবীণ—সবার চোখে জল, সবার মুখে একটাই দোয়া—ওসমান হাদির রুহের মাগফিরাত।
মিরপুর ৬০ ফিট এলাকা থেকে আসা শহিদুর রহমান বলেন, “খুনিরা হাদিকে হত্যা করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। শহীদ হাদি আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। হাদির মতো হাজারো হাদি তৈরি হবে।”
উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর গণসংযোগের উদ্দেশ্যে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় গেলে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে গুলি করা হয় ওসমান হাদিকে। গুলিটি তার মাথায় লাগে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর নেওয়া হলে বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৫টা ৪৮ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিজি-৫৮৫-এ করে তার মরদেহ ঢাকায় পৌঁছায়। পরে মরদেহ হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে রাখা হয়। শনিবার সকালে সেখান থেকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে আবার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে আনা হয়।
আলোকিত গৌড়/আ
মন্তব্য করুন: