ইনসাফ ও ন্যায়বিচার মানব জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ। ন্যায়বিচার মানুষকে সমাজে শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয় করে তোলে। বিশেষত, শাসক বা রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য ইনসাফ অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। ইনসাফবিহীন কোনো নেতা বা শাসক প্রকৃত অর্থে সৎ হতে পারেন না।
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের জীবন্ত প্রতীক। তাঁর জীবন ছিল ইনসাফের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে পরিপূর্ণ। নবুয়তপ্রাপ্তির আগে ও পরে—সব সময়ই তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। বন্ধু-শত্রু, মুসলিম-অমুসলিম, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার সঙ্গে তিনি ন্যায়ের আচরণ করেছেন।
প্রাক-নবুয়ত জীবনে ইনসাফের দৃষ্টান্ত
শৈশবে নবীজি (সা.) দুধমাতা হালিমা সাদিয়ার স্তন থেকে সব সময় ডান দিকের স্তন থেকে দুধ পান করতেন, বাম দিকেরটি রেখে দিতেন দুধভ্রাতা আবদুল্লাহর জন্য—এ ছিল তাঁর স্বভাবজাত ন্যায়বোধের পরিচয়।
এছাড়া সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘হিলফুল ফুজুল’, এক মানবিক সংগঠন যা এতিম-অসহায় ও নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেছিল।
কাবার দেয়ালে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তাঁর ইনসাফপূর্ণ রায়ই সকলকে সন্তুষ্ট করেছিল—যা ইতিহাসে বিখ্যাত দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়েছে।
কোরআনের দৃষ্টিতে ইনসাফ
পবিত্র কোরআনে বারবার ন্যায়বিচারের নির্দেশ এসেছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“নিশ্চয়ই আল্লাহ আদেশ করেন ইনসাফ, মঙ্গলসাধন ও আত্মীয়স্বজনকে দান করার।”
(সুরা: নাহল, আয়াত: ৯০)
আরও ইরশাদ হয়েছে,
“যখন মানুষের মধ্যে বিচার করো, তখন ইনসাফের সঙ্গে বিচার করো।”
(সুরা: নিসা, আয়াত: ৫৮)
হাদিসের আলোকে ইনসাফ
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ন্যায়বিচারের অসংখ্য উদাহরণ হাদিসে পাওয়া যায়।
একবার গনিমতের মাল বণ্টনের সময় এক ব্যক্তি তাঁকে বলেছিল, “ইনসাফ করুন।” নবীজি (সা.) জবাব দিয়েছিলেন,
“আমি হতভাগা হব যদি আমি ইনসাফ না করি।”
(বুখারি, হাদিস: ৩১৩৮)
আরেকবার এক ব্যক্তি বণ্টনে আপত্তি জানালে নবীজি (সা.) বলেন,
“আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যদি ইনসাফ না করেন, তবে কে ইনসাফ করবে!”
(বুখারি, হাদিস: ৩১৫০)
স্ত্রীদের সঙ্গে ন্যায়বিচার
নবীজি (সা.) তাঁর স্ত্রীদের সঙ্গে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ছিলেন সর্বোত্তম উদাহরণ। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন,
“রাসুলুল্লাহ (সা.) পালা বণ্টন করতেন ও বলতেন—‘হে আল্লাহ! এটা আমার সাধ্যের মধ্যে ন্যায়বণ্টন; কিন্তু হৃদয়ের ভালোবাসায় তুমি যেন আমাকে তিরস্কার না করো।’”
(আবু দাউদ, হাদিস: ১২৩৪)
অমুসলিমদের সঙ্গেও ইনসাফ
নবীজি (সা.) কখনও মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে বৈষম্য করেননি। এক ইহুদির সঙ্গে জমি বিরোধের ঘটনায় তিনি ন্যায়নিষ্ঠভাবে সিদ্ধান্ত দেন এবং কুরআনের আয়াত নাজিল হয়—
“যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতি ও নিজেদের শপথকে তুচ্ছমূল্যে বিক্রি করে...”
(সুরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৭৭; বুখারি, হাদিস: ২২৫৬)
উপসংহার
রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন মানবতার ইতিহাসে ইনসাফের সর্বোচ্চ প্রতীক। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—ন্যায় প্রতিষ্ঠা শুধু ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, মানবতার মূল ভিত্তি। তিনি এমন এক দল অনুসারী গড়ে গেছেন, যারা যুগে যুগে ইনসাফের মশাল জ্বালিয়ে রেখেছেন।
তাঁর প্রতি ও তাঁর অনুসারীদের প্রতি অগণিত দরুদ ও সালাম।
আলোকিত গৌড়/আ
মন্তব্য করুন: