ইসলামের প্রথম বাণী ছিল ‘ইকরা’—অর্থাৎ ‘পড়ো’। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার হেরা গুহায় ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নাজিল হয় এই ঐশী নির্দেশ। সেই একটিমাত্র শব্দই মুসলিম সমাজে জ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান গবেষণার শক্ত ভিত রচনা করে দেয়।
ইসলাম জ্ঞানার্জনের যে গুরুত্ব দিয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদে তার দৃষ্টান্ত বিরল। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে জ্ঞানের মর্যাদা নিয়ে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা নিজেই তাঁর রাসুল (সা.)-কে জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন—
‘আর আপনি বলুন—হে আমার প্রভু, আপনি আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন।’ (সুরা ত্বহা: ১১৪)
এ ছাড়া রাসুল (সা.) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘ইলম তথা জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ)
রাসুল (সা.)-এর এই আহ্বানে সাহাবায়ে কেরাম জ্ঞানচর্চায় এমনভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যে, একটি হাদিস শোনার জন্য তাঁরা মদিনা থেকে সিরিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। কেউ কেউ জ্ঞানের সন্ধানে আন্দালুস (স্পেন) থেকে খোরাসান পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছেন।
অনেকে পারিবারিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পালাক্রমে নবীজির (সা.) সান্নিধ্যে থেকে জ্ঞান অর্জন করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে জ্ঞান আহরণে সার্বক্ষণিক নিজেকে নিয়োজিত রাখতে দিনের পর দিন মসজিদে নববীতে অবস্থান করতেন। এই ধারাবাহিক জ্ঞানচর্চাই অন্ধকারাচ্ছন্ন জাহিলিয়াতের সমাজকে পরিণত করেছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বের অনুকরণীয় এক সভ্যতায়।
পরবর্তী সময় মুসলিম মনীষীরা কোরআনের তাফসির, হাদিস, ফিকহ, ভাষাবিজ্ঞান ও দর্শনের পাশাপাশি চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানে অনন্য অবদান রাখেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইবনে সিনার আল-কানুন ফিত-তিব, অস্ত্রোপচারে জাহরাভির আত-তাসরিফ, গণিতে আল-খাওয়ারিজমির হিসাবুল জাবরি ওয়াল মুকাবালাহ, জ্যোতির্বিদ্যায় আল-বিরুনির কানুনে মাসউদি, ইতিহাসে ইবনে খালদুনের মুকাদ্দিমাসহ শত শত গ্রন্থ যুগ যুগ ধরে মানবসভ্যতার পথপ্রদর্শক হয়ে আছে।
এই গ্রন্থগুলো আরবি ভাষা থেকে লাতিন ও ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নবজাগরণ ঘটে। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত্তি নির্মাণে মুসলিম বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের অবদান অকপটে স্বীকার করেছেন বহু ইউরোপীয় গবেষক।
প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ কার্লাইল লিখেছেন, “আরবরা ছিল মরুচারী বেদুইন। কিন্তু যখন তাদের মধ্যে একজন নবীর আবির্ভাব ঘটল, তখন তারাই অল্প সময়ের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো এবং সমগ্র বিশ্বকে আলোকিত করে ফেলল।”
বিশ্লেষকদের মতে, আধুনিক বিশ্বের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পেছনে মুসলিম মনীষীদের নিরলস জ্ঞানসাধনা ও বিদ্যাচর্চার ভূমিকা অনস্বীকার্য। মুসলিমরাই ছিলেন বিশ্বসভ্যতার প্রথম ও প্রকৃত দীপাধার।
আলোকিত গৌড়/আ
মন্তব্য করুন: